জাতীয়

বঙ্গবন্ধু উপগ্রহ : কমিশনের লোভে বড় ধরনের দুর্নীতি

তাসলিমা জামান: বাংলাদেশের নতুন বোয়িং পালকি কেনার ৩ মাসের মাথায় সিট ,ডিসপ্লে সহ অনেক কিছু নষ্ট হয়ে গেছে। এবার মহাকাশে বাংলাদেশের নিজস্ব যোগাযোগ ও সম্প্রচার উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণের প্রথম উদ্যোগেও বড় ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম।

অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের স্পেস পার্টনারশিপ ইন্টারন্যাশনাল (এসপিআই) নামের এক অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়ার সব প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে। এ অবস্থায় বর্তমান সরকারের মেয়াদে মহাকাশে উপগ্রহ উৎক্ষেপণের বিষয়টি এখন অনিশ্চয়তার মুখে।

‘ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প-২০২১’ বাস্তবায়নে বাংলাদেশের মহাকাশ যুগে প্রবেশ অন্যতম অগ্রাধিকার হলেও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) দুর্নীতি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বহীনতায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

জানা গেছে, ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের স্পেস পার্টনারশিপ ইন্টারন্যাশনাল (এসপিআই) নামের প্রতিষ্ঠানটিকে প্রতিযোগিতা এড়িয়ে ৮২ কোটি ৪২ লাখ টাকায় পরামর্শক নিয়োগের প্রচেষ্টা চলছে। এর কৌশলগত অংশীদার আর এফ কে ইঞ্জিনিয়ারিং সলিউশন্স এলএলসি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৩ সালে। এ কারণে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রাথমিক বাছাইয়ে সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্তিই (শর্টলিস্ট) বৈধভাবে হয়নি এসপিআই’র। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এসপিআইকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দিতে বেশি নম্বর পাওয়া অভিজ্ঞ কোম্পানি গ্লোবকম অ্যান্ড টেলিস্পেস সিস্টেম ইনক ও টেলিস্যাটকে সারা দেওয়া হয়নি। এতেকরে মান ও দর ভিত্তিক (কোয়ালিটি অ্যান্ড কস্ট বেইজড) না হয়ে দুর্নীতি ও জালিয়াতির মাধ্যমে পরামর্শক নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয়। এদিকে মূল্যায়নে গুরুতর অনিয়ম ও অসঙ্গতির কারণে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির গত ১২ ফেব্রুয়ারির সভায় এসপিআই এর নিয়োগ প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়নি। এখন নতুন মূল্যায়ন প্রতিবেদন ও কাগজপত্র দিয়ে পুনরায় অনুমোদনের যে চেষ্টা চলছে, তাতে আরও বড় জালিয়াতি হয়েছে বলে সূত্র জানায়। সূত্র মতে, এ ক্রয় প্রস্তাবটি অনুমোদিত হলে ভবিষ্যতে সংশ্লিষ্ট সবাই ফেঁসে যাবেন বলেই খোদ মূল্যায়ন কমিটির সদস্যরাই আতঙ্কে রয়েছেন।

বিটিআরসির এ সম্পর্কিত একাধিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, পরামর্শক নিয়োগের জন্য ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ২৯টি প্রতিষ্ঠান বৈধ আগ্রহ দেখিয়ে (ইওআই) প্রস্তাব জমা দেয়। মহাপরিচালক রেজাউল কাদেরের নেতৃত্বাধীন ৭ সদস্যের মূল্যায়ন কমিটি ৭টি প্রতিষ্ঠানকে ‘অসাধারণ’ (এঙ্েিলন্ট) বিবেচনায় সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত করে। গত বছরের ১৬ মার্চ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহকে জানিয়ে তাদের কাছে প্রস্তাবনা আকারে দরপত্রের অনুরোধ পত্র পাঠানো হয়। পরবর্তীতে সরকারি মালিকানাধীন ও স্যাটেলাইট নির্মাণে জড়িত থাকার অদ্ভুত শর্তারোপ করে রাশিয়ার ইনফরমেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম এবং জার্মানির লেস স্পেস অপারেশন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এজিকে আরএফপিতে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। যদিও গণখাতে ক্রয় আইন ও বিধি (পিপিএ ও পিপিআর) অনুযায়ী তালিকাভুক্তির পর নতুন শর্তারোপের সুযোগ নেই। ফলে গত বছরের ২৭ এপ্রিল অন্য ৫টি প্রতিষ্ঠান কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাব দাখিল করে।

জানা গেছে, বিটিআরসির কমিশনার মলি্লক সুধীর চন্দ্রের নেতৃত্বাধীন ৭ সদস্যের প্রস্তাব মূল্যায়ন কমিটিতে বিটিআরসির বাইরের ৩ জন সদস্য ছিলেন। গত বছরের ১৯ জুলাই কমিটির কারিগরি মূল্যায়নের সারসংক্ষেপে দেখা যায়, ৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ফ্রান্সের স্যাটকনসাল্টকে ৭২.৪৫ নম্বর দিয়ে নন-রেসপনসিভ (অযোগ্য) এবং এসপিআইকে ৮০.০৭ নম্বর দিয়ে রেসপনসিভ (যোগ্য) দেখানো হয়েছে। অন্য ৩ প্রতিযোগী- ইন্দোনেশিয়ার পিটি টেলিকমিউনিকাসি ইন্দোনেশিয়া ইন্টারন্যাশনাল, গ্লোবকম অ্যান্ড টেলিস্পেস এবং কানাডার টেলিস্যাটকে অযোগ্য দেখিয়ে কোনো নম্বরই দেওয়া হয়নি। প্রয়োজনীয় ৮০ নম্বরের মধ্যে ৮০.০৭ নম্বর পাওয়ার এসপিআইকে কারিগরিভাবে যোগ্য ঘোষণা করে আর্থিক প্রস্তাব খুলে মূল্যায়ন করে ৯ কোটি ৬৯ লাখ ৭০ হাজার টাকার ট্যাঙ্সহ ৭৬ কোটি ৫৭ লাখ ২৭ হাজার ৮৩৪ টাকায় বৈদেশিক পরামর্শক নিয়োগের প্রস্তাব গত ১৭ আগস্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এ বছরের ১৬ ডিসেম্বর উপগ্রহ উৎক্ষেপণের কথা বলে অত্যন্ত তাড়াহুড়া করে প্রস্তাব মূল্যায়ন করা হলেও মন্ত্রণালয় দীর্ঘ প্রায় ৬ মাস বিষয়টি ধরে রাখে। পরে গত ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় প্রস্তাবটি উপস্থাপিত হলেও নানা অনিয়ম ও অসঙ্গতির কারণে অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়নি। তবে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার ভিত্তিতে আগ্রহ প্রস্তাব এবং কারিগরি প্রস্তাবের যে মূল্যায়ন প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে তাতে অস্বচ্ছতা, পক্ষপাত আর জালিয়াতির নানা প্রমাণ রয়েছে।

সূত্র জানায়, ২০১০ সালের ডিসেম্বরে প্রাপ্ত ইওআই-এর ভিত্তিতে গত বছরের মার্চে ৭টি প্রতিষ্ঠানকে সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত করা হলেও বিটিআরসির ৭ সদস্যের ইওআই মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করেছেন ৬ জন। এতে স্বাক্ষরের তারিখ ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২।

বিটিভির প্রধান প্রকৌশলী এতে স্বাক্ষর করেননি। অন্যদিকে গত বছরই অবসরে যাওয়া ইওআই মূল্যায়ন কমিটির প্রধান বিটিআরসির সাবেক মহাপরিচালক মো. রেজাউল কাদের আগের পদবি ব্যবহার করেই স্বাক্ষর করেছেন।

এ প্রতিবেদনে স্বাক্ষর না করলেও বিটিভির প্রধান প্রকৌশলী মহেশ চন্দ্র রায় আরএফপির নতুন মূল্যায়ন প্রতিবেদনের জন্য তার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন শিটের ৯টি পৃষ্ঠার প্রতিটিতে স্বাক্ষর করেছেন। তবে তিনি ছাড়াও কম্পিউটার কাউন্সিলের সচিব ইঞ্জি. মো. এনামুল কবীর এবং বিটিআরসির উপ-পরিচালক মো. গোলাম রাজ্জাক স্বাক্ষরের সঙ্গে অন্য ৪ জনের মতো ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১২ তারিখ উল্লেখ করেননি। তবে মূল্যায়ন কমিটির সদস্যদের ব্যক্তিগত মূল্যায়ন নামে যে সব শিটে তাদের স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে, তাতে প্রদত্ত নম্বর সংশ্লিষ্ট সদস্যদের দেওয়া নয় বলে প্রমাণ মিলেছে। বিটিআরসি থেকে কম্পিউটারে তৈরি করা নম্বর শিটেই কেবল সদস্যদের স্বাক্ষর করতে বলা হয়েছে। সরকারি চাকরি করেন বলে অনেকেই চাকরি রক্ষার জন্য বিবেকের বিরুদ্ধে গিয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি ও এর পরে এতে স্বাক্ষর করেন বলে জানা গেছে। এ জন্য ১৫ ফেব্রুয়ারি বা এর আগে পরে বিটিআরসি কোনো সভাও আহ্বান করেনি।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। কারিগরি মূল্যায়নে গ্লোবেকম অ্যান্ড টেলিস্পেস লি. সিস্টেম সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ায় কমিটির প্রধান বিটিআরসির মলি্লক সুধীর চন্দ্রও কর্তৃপক্ষের ধমক খেয়েছেন। এ ছাড়া বিটিআরসি বাইরের তিন সদস্যকেও দুই দফা ডেকে এসপিআই এর বিষয়ে সরকারের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের নির্দেশের বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়। এ কারণে ৭ জন সদস্যদের প্রদত্ত ভিন্ন ভিন্ন ‘নম্বরপত্র’ ও মোট নম্বরপত্র ফেলে দিয়ে গত বছরের ১৯ জুলাইয়ের কারিগরি মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এসপিআই ৮০.০৭ নম্বর এবং স্যাটকনসাল্ট ৭২.৪৫ নম্বর পেয়েছে বলে দেখানো হয়। মূল্যায়নে অন্য তিন প্রতিষ্ঠানকে কোনো নম্বর দেওয়া হয়নি অথচ এখন ক্রয় কমিটির জন্য যে নতুন কারিগরি মূল্যায়ন তৈরি করা হয়েছে তাতে এ তিনটি প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় ৮০-এর চেয়ে কম নম্বর পেয়েছে বলে দেখানো হয়েছে। যা একেবারেই বিটিআরসির মনগড়া। ফলে নিরপেক্ষ কোনো সংস্থার পুনর্মূল্যায়ন ছাড়া পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হলে তাতে নানা প্রশ্ন উঠবে।

About EUROBDNEWS.COM

Popular Online Newspaper

Discussion

Comments are closed.